কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজ-সংস্কারক। মূলত কবি হিসেবেই তাঁর প্রতিভা বিশ্বময় স্বীকৃত। ১৯১৩ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এশিয়ার বিদগ্ধ ও বরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই পুরস্কার জয়ের গৌরব অর্জন করেন।
রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনের প্রেক্ষাপটেই তাঁর কবিমানস ও সাহিত্যকর্মের স্বরূপ অনুধাবন সম্ভব। জীবনের পর্বে পর্বে তাঁর জীবনজিজ্ঞাসা ও সাহিত্যাদর্শের পরিবর্তন ঘটেছে। যুগে যুগে পৃথিবীতে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে রূপান্তর ঘটেছে, রবীন্দ্রনাথ সবকিছুকেই আত্মস্থ করেছেন গভীর অনুশীলন, ক্রমাগত নিরীক্ষা এবং বিশ্বপরিক্রমার মধ্য দিয়ে। তাই তাঁর সাহিত্যজীবনের নানা পর্যায়ে বিষয় ও আঙ্গিকের নিরন্তর পালাবদল লক্ষণীয়। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল তাঁর অসংখ্য কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, ভ্রমণকাহিনী, চিঠিপত্র এবং দেশে বিদেশে প্রদত্ত বক্তৃতামালা। রবীন্দ্রনাথের অন্তর্নিহিত জীবনবোধ ছিল স্থির এবং বহু পরিবর্তনকে স্বীকার করে নিয়েও আপন আদর্শে প্রতিষ্ঠিত; অন্যদিকে তাঁর সৃজনশীল রূপটি ছিল চলিষ্ণু ও পরিবর্তনশীল। রবীন্দ্রনাথ কেবল তাঁর কালের কবি নন, তিনি কালজয়ী। বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর আবির্ভাব ছিল এক যুগান্তর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর অভিজাত ঠাকুর পরিবারে। রবীন্দ্রনাথ বহু কাব্য, গান, নৃত্যনাট্য, ভ্রমণকাহিনী, সমালোচনা, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ রচনা করেন। এ পর্বে এসে তাঁর রচনায় নতুন যুগের স্পর্শ লাগে। এ সময়ে রচিত তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় পনেরোটি। তার মধ্যে পুনশ্চ (১৯৩২), শেষ সপ্তক (১৯৩৫), পত্রপুট (১৯৩৬) ও শ্যামলী (১৯৩৬) গদ্যছন্দে লেখা। এ পর্যায়ে রবীন্দ্রমানসে একটা নিগূঢ় পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। কবি ক্রমশ বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠেন, তাঁর চেতনায় নেমে আসে দার্শনিক নির্লিপ্ততা। কবিতাগুলিও হয়ে ওঠে নিরাভরণ এবং ধ্যানগম্ভীর। মৃত্যুচেতনা তাঁকে মাঝে মাঝে আচ্ছন্ন করে। তার প্রতিফলন ঘটে প্রান্তিক (১৯৩৮)-এর কবিতায়। কবির মন আবার ধাবিত হয় মানবসমাজের দিকে, রূপকথার জগতে, বাউলের মনের মানুষের সন্ধানে, শৈশবস্মৃতিতে, পীড়িত মানুষের বেদনায়। কিন্তু অন্যদিকে সাহিত্য নিয়ে পরীক্ষা এবং নতুন সৃষ্টি চলতে থাকে। এবার তিনি লেখেন গদ্যগান। নৃত্যনাট্যগুলি তাঁর অপূর্ব সৃষ্টি। পুরানো কবিতাকে তিনি রূপ দেন নৃত্যনাট্যে; রচনা করেন চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা ও চন্ডালিকা। নটরাজ, নবীন, শ্রাবণগাথা এগুলি নিসর্গ প্রকৃতির সঙ্গীতরূপ। কবির শেষ দশকের উপন্যাস দুইবোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) এবং চার অধ্যায় (১৯৩৪)।
বিশ্বমনস্ক কবি মৃত্যুর পূর্বে প্রত্যক্ষ করেছেন মানবসভ্যতার গভীর সঙ্কটকে। তথাপি তিনি মানুষের মহত্ত্বে চির-আস্থাবান ছিলেন। কালান্তর (১৯৩৭) ও সভ্যতার সঙ্কট (১৯৪১)-এ কবির সেই বিশ্বাসের সুর অক্ষুণ্ণ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের অন্তিম বাণী সভ্যতার সঙ্কট। এ ভাষণ তিনি পড়েছিলেন তাঁর শেষ জন্মোৎসব অনুষ্ঠানে। সেবার কবির আশি বছর পূর্ণ হয়। ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কবি কালিম্পঙ গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ ১৩৪৮) জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
Biography
কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, চিত্রশিল্পী, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ ও সমাজ-সংস্কারক। মূলত কবি হিসেবেই তাঁর প্রতিভা বিশ্বময় স্বীকৃত। ১৯১৩ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। এশিয়ার বিদগ্ধ ও বরেণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই পুরস্কার জয়ের গৌরব অর্জন করেন।
রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনের প্রেক্ষাপটেই তাঁর কবিমানস ও সাহিত্যকর্মের স্বরূপ অনুধাবন সম্ভব। জীবনের পর্বে পর্বে তাঁর জীবনজিজ্ঞাসা ও সাহিত্যাদর্শের পরিবর্তন ঘটেছে। যুগে যুগে পৃথিবীতে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা, দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে রূপান্তর ঘটেছে, রবীন্দ্রনাথ সবকিছুকেই আত্মস্থ করেছেন গভীর অনুশীলন, ক্রমাগত নিরীক্ষা এবং বিশ্বপরিক্রমার মধ্য দিয়ে। তাই তাঁর সাহিত্যজীবনের নানা পর্যায়ে বিষয় ও আঙ্গিকের নিরন্তর পালাবদল লক্ষণীয়। এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফসল তাঁর অসংখ্য কবিতা, গান, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্য, ভ্রমণকাহিনী, চিঠিপত্র এবং দেশে বিদেশে প্রদত্ত বক্তৃতামালা। রবীন্দ্রনাথের অন্তর্নিহিত জীবনবোধ ছিল স্থির এবং বহু পরিবর্তনকে স্বীকার করে নিয়েও আপন আদর্শে প্রতিষ্ঠিত; অন্যদিকে তাঁর সৃজনশীল রূপটি ছিল চলিষ্ণু ও পরিবর্তনশীল। রবীন্দ্রনাথ কেবল তাঁর কালের কবি নন, তিনি কালজয়ী। বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর আবির্ভাব ছিল এক যুগান্তর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৬১ সালের ৭ মে (১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর অভিজাত ঠাকুর পরিবারে। রবীন্দ্রনাথ বহু কাব্য, গান, নৃত্যনাট্য, ভ্রমণকাহিনী, সমালোচনা, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ রচনা করেন। এ পর্বে এসে তাঁর রচনায় নতুন যুগের স্পর্শ লাগে। এ সময়ে রচিত তাঁর কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা প্রায় পনেরোটি। তার মধ্যে পুনশ্চ (১৯৩২), শেষ সপ্তক (১৯৩৫), পত্রপুট (১৯৩৬) ও শ্যামলী (১৯৩৬) গদ্যছন্দে লেখা। এ পর্যায়ে রবীন্দ্রমানসে একটা নিগূঢ় পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। কবি ক্রমশ বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠেন, তাঁর চেতনায় নেমে আসে দার্শনিক নির্লিপ্ততা। কবিতাগুলিও হয়ে ওঠে নিরাভরণ এবং ধ্যানগম্ভীর। মৃত্যুচেতনা তাঁকে মাঝে মাঝে আচ্ছন্ন করে। তার প্রতিফলন ঘটে প্রান্তিক (১৯৩৮)-এর কবিতায়। কবির মন আবার ধাবিত হয় মানবসমাজের দিকে, রূপকথার জগতে, বাউলের মনের মানুষের সন্ধানে, শৈশবস্মৃতিতে, পীড়িত মানুষের বেদনায়। কিন্তু অন্যদিকে সাহিত্য নিয়ে পরীক্ষা এবং নতুন সৃষ্টি চলতে থাকে। এবার তিনি লেখেন গদ্যগান। নৃত্যনাট্যগুলি তাঁর অপূর্ব সৃষ্টি। পুরানো কবিতাকে তিনি রূপ দেন নৃত্যনাট্যে; রচনা করেন চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা ও চন্ডালিকা। নটরাজ, নবীন, শ্রাবণগাথা এগুলি নিসর্গ প্রকৃতির সঙ্গীতরূপ। কবির শেষ দশকের উপন্যাস দুইবোন (১৯৩৩), মালঞ্চ (১৯৩৪) এবং চার অধ্যায় (১৯৩৪)।
বিশ্বমনস্ক কবি মৃত্যুর পূর্বে প্রত্যক্ষ করেছেন মানবসভ্যতার গভীর সঙ্কটকে। তথাপি তিনি মানুষের মহত্ত্বে চির-আস্থাবান ছিলেন। কালান্তর (১৯৩৭) ও সভ্যতার সঙ্কট (১৯৪১)-এ কবির সেই বিশ্বাসের সুর অক্ষুণ্ণ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের অন্তিম বাণী সভ্যতার সঙ্কট। এ ভাষণ তিনি পড়েছিলেন তাঁর শেষ জন্মোৎসব অনুষ্ঠানে। সেবার কবির আশি বছর পূর্ণ হয়। ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কবি কালিম্পঙ গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন থেকে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (২২ শ্রাবণ ১৩৪৮) জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।